বিশেষ প্রতিবেদক, প্রথম বাংলা
‘শেখ হাসিনা আমাকে মিসগাইড করেছে, প্রেসারাইজ করেছে, এক হিসেবে ব্ল্যাকমেইল করেছে।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক অডিওতে এমন চাঞ্চল্যকর কথা বলতে শোনা যাচ্ছে ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াকে।
এর আগেও একাধিক নারী পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আছাদুজ্জামানের যৌনালাপের অডিও ভাইরাল হয়। তবে এবার ফাঁস হওয়া অডিওতে সাবেক ডিএমপি কমিশনার দোষারোপ করছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
চাঞ্চল্যকর অডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর আছাদুজ্জামান মিয়াকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছেন। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী পুলিশ কর্মকর্তাদের অন্যতম ডিএমপির এই সাবেক কমিশনার।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৫-১৬ সালের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন দমানো, বিভিন্ন থানায় হত্যা, গুম, এনকাউন্টারের নামে ক্রসফায়ারের অজস্র ঘটনার অন্যতম হোতা তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।
পুলিশের চাকরিজীবনে আছাদুজ্জামান মিয়া নানান সময় আলোচিত-সমালোচিত। অবসরে যাওয়ার পরও আলোচনায় ছিলেন সব সময়। সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের সময় ফরিদপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুর রহমানের পক্ষে প্রচারণায় তিনি ডিএমপির লোগোযুক্ত (ঢাকা মেট্রো-গ ২৮-৭৪৩৬ নম্বর প্লেট) গাড়ি ব্যবহার করেন বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন।
বিধি অনুযায়ী, কোনো প্রার্থীর পক্ষে সরকারি সুযোগ-সুবিধা বা গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ নেই। অথচ অবলীলায় সেই কাজটি করেন আছাদুজ্জামান মিয়া। ১৫০০ সিসির গাড়িটি ২০১৯ সালে ৩ সেপ্টেম্বর পুলিশের নামে রেজিস্ট্রেশন হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত অফিসিয়াল সুযোগ-সুবিধাকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে ডিএমপির সাবেক এ কমিশনারের বিরুদ্ধে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশকে অস্ত্র ব্যবহারে পরামর্শদাতাদের একজন বলেও গণমাধ্যমে খবর হয়েছে।
এদিকে ব্যক্তিজীবনে তিন ছেলে-মেয়ের পিতা আছাদুজ্জামান মিয়ার নারী কেলেঙ্কারির ঘটনাও তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। একাধিক নারী পুলিশ সদস্যের সঙ্গে তার রগরগে যৌনালাপে ছি ছি রব পড়েছে। সবাই ধিক্কার জানাচ্ছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ সাবেক এই উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে।
অভিযোগ রয়েছে, আছাদুজ্জামান মিয়া পছন্দমাফিক কতিপয় অধস্তন নারী অফিসারদের নিজ অফিসে ডেকে নিয়ে যেতেন। কখনোবা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় একান্ত সময় কাটাতেন। পুলিশের কতিপয় নারী সদস্যকে বাধ্য করতেন যৌন সম্পর্কে জড়াতে।
সাবেক এ ডিএমপি কমিশনার বছরের পর বছর এমন অনেক নারীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্কে জড়ানোর নেশায় মেতেছিলেন। কিছু নারী পুলিশ কর্মকর্তাও পদোন্নতি, অর্থবিত্ত আর অবৈধ প্রভাব বিস্তারের নেশায় তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেন।
পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থাকাকালীন আছাদুজ্জামানে নারী লিপ্সা বাহিনীটির নৈতিক মানও ধ্বংস করেছে। ডিএমপি কমিশনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, একের পর এক এমন অনেক অপকর্মও করে গেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে পুলিশ প্রশাসনে নানা রকম দুর্নীতি হয়েছিল। এসবের পেছনে থাকা রাঘববোয়ালরা এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। তবে ক্ষমতার পালাবদলে এখন সেসব পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি একের পর এক বেরিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে অন্যতম আছাদুজ্জামান মিয়ার দুর্নীতি।
এদিকে আছাদুজ্জামান মিয়া ও তার স্ত্রী, দুই ছেলে-মেয়ে, শ্যালক ও মেয়ের জামাইয়ের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারি-বেসরকারি ৩০টি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়েছে দুদক।
এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর তার ব্যাংক হিসাব ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে জব্দের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
গত ১৮ আগস্ট কমিশন সভায় আছাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। পরে ২৮ আগস্ট কমিশনের উপ-পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীরকে প্রধান করে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির আরেক সদস্য হলেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আলিয়াজ হোসেন।
দুদক সূত্র জানায়, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার স্ত্রীর নামে ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুটি ফ্ল্যাট এবং মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ৬৭ শতক জমি রয়েছে। এই তিন জেলায় তার পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে আরও ১৬৬ শতক জমি।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১-এ ১৬৬ এবং ১৬৭ নম্বরে ১০ কাঠা জমির ওপর ছয়তলা একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া গাজীপুরের কালীগঞ্জের চাঁদখোলা মৌজায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সর্বমোট ১০৬ শতক জমি কেনা হয় আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে।
এছাড়া ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় আফরোজার নামে ২৮ শতক জমি কেনা হয়। একই বছর একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমি কেনা এবং পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোডে ১০ কাঠা জমি রয়েছে।
এছাড়া পরিবারের সদস্যদের নামে রাজধানীর আফতাবনগরে ৩ নম্বর সেক্টরের এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোডে ২৬ নং প্লটে ২১ কাঠা জমি এবং নিকুঞ্জ-১-এ ছোট ছেলের নামে একটি বাড়ি রয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে তথ্য এসেছে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা আছাদুজ্জামানের নিকুঞ্জের বিলাসবহুল বাড়িতে ভাংচুর-হামলাও চালায়। এছাড়াও ফরিদপুরে আছাদের দখল থেকে নিজেদের বিপুল জমি উদ্ধার করেছে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার।
গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার মহাখালী এলাকা থেকে আছাদুজ্জামান মিয়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে খিলগাঁও থানায় দায়ের করা ছাত্রদল নেতা জনি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বর্তমানে তিনি পুলিশের রিমান্ডে আছেন। এছাড়া উত্তরায় এক পোশাককর্মীকে হত্যার মামলায়ও আসামি সাবেক এই ডিএমপি কমিশনার।